মোদি ঢাকায় আসছেন চীনের দুশ্চিন্তা নিয়ে
দক্ষিণ এশিয়া থেকে চীনের প্রভাব দূর করার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সফরে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদিও সামরিক সরঞ্জামের ব্যাপারে ঢাকা বেইজিংয়ের ওপরই নির্ভরশীল থাকছে।
কয়েক দশক ধরে চীনের সঙ্গে ভারতের একটি অস্বস্তিকর সম্পর্ক বিরাজমান। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী, বিশেষ করে পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দেওয়ায় এ সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে অস্থির হয়ে আছে।
পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের বন্দর উন্নয়ন করে ভারত মহাসাগরজুড়ে চীন যে 'মুক্তোর মালা' (স্ট্রিং অব পার্লস) তৈরি করছে, সেটা নিয়েও উদ্বিগ্ন ভারত।
বাংলাদেশকে অল্প পরিমাণ জমি দেওয়া হবে, এ ব্যাপারে পার্লামেন্টের অনুমোদনও পেয়েছেন মোদি। অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার মুখে পড়ার আশঙ্কায় এর আগের কংগ্রেস সরকার এটা পারেনি। এই ইস্যুটি ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর থেকে চলে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আঞ্চলিক এক নেতাকে (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) তার পানি বণ্টন চুক্তি (তিস্তা চুক্তি) নিয়ে বিরোধিতা না করার জন্য বলেছেন।
মোদির ৬-৭ জুন ঢাকা সফরের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন এমন এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, 'স্থলসীমান্ত চুক্তির মতো কিছু বিতর্কিত ইস্যু রয়েছে। সত্যি বলতে কি, সেগুলো বহু বছর আগেই মিটমাট হওয়ার দরকার ছিল।'
বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষের ভারতে অভিবাসন একটি সংবেদনশীল ইস্যু, মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি এই অভিবাসনের বিরোধিতা করে।
তবে যখন থেকে ক্ষমতায় এসেছেন মোদি, অভিবাসন ইস্যুতে নিশ্চুপ এবং বাংলাদেশে কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের ওপর তাগিদ দিয়েছেন।
নয়াদিল্লিতে জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির চীনা বিশেষজ্ঞ শ্রীকান্ত কোন্ডাপাল্লি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং এটাই ভারতের উদ্বেগের বিষয়। তিনি জানান, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি যতবার বাংলাদেশ সফর করেছে, তা ভারতের সেনাবাহিনীর সমান।
বছরখানেক আগে ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তান ছাড়া সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মোদি। বাংলাদেশের সাবেক এক সামরিক কর্মকর্তা ও ভারত বিশেষজ্ঞ বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সামরিক সম্পর্ক নিয়ে প্রত্যেক ভারতীয় উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের কাছে সাবমেরিন বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। ভারতের উদ্বেগের বিষয়টি ঢাকায় প্রভাব পড়বে না বলে তিনি জানান।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) জানায়, ২০০৯-২০১৩ পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট অস্ত্র ক্রয়ের ৮২ শতাংশই আসে চীন থেকে। বিশ্বের চীনের অস্ত্র বিক্রির তৃতীয় বৃহত্তম ক্রেতা বাংলাদেশ।
এসআইপিআরআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ ও ২০১২-এর মধ্যে চীনের কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী জাহাজ, ট্যাঙ্ক, ফাইটার এয়ারক্রাফট ও অন্যান্য অস্ত্র ক্রয় করে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহেদুল আনাম খান বলেন, 'ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে বাংলাদেশের বৃহত্তর অস্ত্র সরঞ্জাম সরবরাহকারী দেশ হয়ে যায় চীন।'
সরকারি এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের প্রথম সাবমেরিন দুটির খরচ পড়ছে ২০৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (২০ কোটি ৬০ লাখ ডলার), ২০১৯ সালের আগে এগুলো সরবরাহ করবে চীন।
ভারতের সামরিক পরিকল্পনাকারীদের যে বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে, সেটা হচ্ছে যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন ভেড়ানোর জন্য বাংলাদেশকে আদর্শ জায়গা বিবেচনা করতে পারে চীন।
গত বছর শ্রীলঙ্কায় চীনের সাবমেরিন একই রকম কাজ করায় ভারত উদ্বিগ্ন হয়। নিকট ভবিষ্যতে কোনো সাবমেরিন ভিড়বে না বলে জানায় শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার।
চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য নেই। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের সরকারি এক কর্মকর্তা জানান, দেশটি কখনো চীনের নৌজাহাজকে স্বাগত জানায়নি, এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনাও নেই।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর উন্নয়নের কাজ করছে চীন। আর বঙ্গোপসাগরে কক্সবাজার উপকূলে সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ঠিকাদারি পেতে এগিয়ে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। বন্দরটি নির্মাণে খরচ হবে ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার। ভারতের আদানি গ্রুপও প্রকল্পের কাজ পেতে লড়াই করছে।
বাংলাদেশের এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, সোনাদিয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কবে হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না। তিনি জানান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও নেদারল্যান্ডসের সমুদ্রবন্দর অপারেটররাও আগ্রহী।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশী ফয়েজ আহমাদ বলেন, 'কাজটি চীন পেলে সবচেয়ে ভালো হবে।' তিনি জানান, চীনের বিভিন্ন কোম্পানি বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র, সেতু, সড়কসহ অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করেছে।
ভারতের নৌবাহিনী চীন-বাংলাদেশের সামরিক সম্পর্ক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
ঢাকায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাকী চক্রবর্তী বলেন, 'উদ্বেগটা বাংলাদেশের সামরিক সামর্থ্য নিয়ে নয়। পাশের দরজায় চীনের প্রভাব নিয়েই উদ্বেগ।' রয়টার্স অবলম্বনে
No comments:
Post a Comment